কাপ্তাই বাঁধ
পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে আমেরিকার অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ শেষ হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং ইউতাহ ইন্টারন্যাশনাল ইনকর্পোরেট ৬৭০.৬ মিটার দীর্ঘ ও ৫৪.৭ মিটার উচ্চতার এ বাঁধটি নির্মাণ করে। এ বাঁধের পাশে ১৬টি জলকপাট সংযুক্ত ৭৪৫ ফুট দীর্ঘ একটি পানি নির্গমন পথ বা স্প্রিলওয়ে রাখা হয়েছে। এ স্প্রিলওয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক ফিট পানি নির্গমন করতে পারে। এ প্রকল্পের জন্য তখন প্রায় ২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা বাজেট নির্ধারণ করা হলেও পরে তা ৪৮ কোটি ছাড়িয়ে যায়।[১]
পর্যটন
কাপ্তাই লেককে ঘিরেই মূলত রাঙামাটি জেলার পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে। এই লেকের উপর রয়েছে বিখ্যাত ঝুলন্ত ব্রীজ। লেকের দুই ধারই পাহাড়-টিলা দিয়ে ঘেরা। ট্রলার ভাড়া করে লেকে ভ্রমণ করা যায়। ট্রলারে করে যাওয়া যায় শুভলং জলপ্রাপাতে। লেকের পাড়ে রয়েছে নতুন চাকমা রাজবাড়ি ও বৌদ্ধ মন্দির। পুরাতন চাকমা রাজবাড়ি কাপ্তাই বাঁধ নির্মানের সময় লেকে তলিয়ে যায়। রাজবন বিহার বাংলাদেশে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বৃহত্তম বিহার রাঙামাটি শহরের অদূরেই অবস্থিত, যা পূণার্থী এবং দর্শনার্থীদের অন্যতম আর্কষনীয় স্থান।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও হ্রদটি অন্যান্য দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। লেকটির মাধ্যমে একটি বৈচিত্রপূর্ণ ও দীর্ঘ জলপথের সৃষ্টি হয়েছে। আগে যেখানে অনেক জায়গায় যেতে সারাদিন বা তারও বেশি লেগে যেত, এখন সেখানে স্পিড বোট বা লঞ্চে যেতে লাগছে মাত্র কয়েক ঘন্টা সময়। পাহাড়ব্যাপী জঙ্গলে বনজ সম্পদ অনুসন্ধানে এখন অনেক দূর্গম অঞ্চলেও সহজে ঢোকা সম্ভব হচ্ছে। সমগ্র হ্রদটি পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। কৃষি ও মৎস্যসম্পদ উন্নয়নেও হ্রদটির অবদান উল্লেখযোগ্য। বছরের বিভিন্ন মাসে হ্রদে পানির উচ্চতা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায়, হ্রদতীরবর্তী এলাকা এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় সেচ সুবিধা লাভ করছে যা চাষের জন্য জমিকে খুব উর্বর করে তুলছে। এখানকার জনগণ স্থানীয় সরকার-এর সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে ইজারা ব্যবস্থায় প্রায় ৬,০৭৫ হেক্টর এলাকায় নিয়ন্ত্রিত কৃষিকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। হ্রদটির আনুমানিক আয়ুষ্কাল ৯০ বছর যার পর এর তলদেশ পলিপাথরের আস্তরণে সম্পূর্ণ মজে যাওয়ার কথা। সে পর্যন্ত হ্রদটি হ্যাচারী ও মৎস্য উৎপাদনের মূল্যবান আধার হিসেবে চালু থাকবে। জলাধারের উৎপাদিত মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও দেশের অন্যান্য এলাকায় চালান করা হয়। বার্ষিক মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ ৭,০০০ টনের বেশি। তবে বর্ষাকালে ঘন ঘোলাস্রোতের কারণে প্ল্যাঙ্কটন উৎপাদন ব্যাহত হয়। তবে পানির স্রোতের সঙ্গে বয়ে আসে অতি উচ্চমানের পুষ্টি সরবরাহ। তাই পানি পরিষ্কার হয়ে এলে প্ল্যাঙ্কটনের উৎপাদন আবার বৃদ্ধি পায়। নীলসবুজ ও সবুজ শৈবাল ও ডায়াটম এ জলাধারের উদ্ভিদকণার প্রধান উপাদান যা রুই-কাতল মাছের প্রধান খাদ্য। এখানকার জুপ্লাঙ্কটন (zooplankton) রোটিফার (rotifers) দ্বারা প্রভাবিত। অন্যান্য জুপ্লাঙ্কটনের উপাদান খুবই কম যা অধিকাংশ গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলাধারের বৈশিষ্ট্য। বেন্থিক প্রাণীকুলের (Benthic fauna) মধ্যে রয়েছে প্রধাণত রক্ত-কৃমি বা জোঁক (leesh), শামুকজাতীয় প্রাণী, এনিলিডস ও কেওবারিডস।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন, ফ্রেশ ওয়াটার রিসার্চ সাব-স্টেশন এবং অ্যাকুয়াটিক রিসার্চ গ্রুপ-এর ব্যাপক মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণের রেকর্ড থেকে দেখা গেছে ১৯৮৫ সালে হ্রদে মাছের প্রধান প্রজাতি রুই এর উৎপাদন দারুণভাবে কমে যায়, যা ছিল কাপ্তাই লেকের মৎস্য উৎপাদন ইতিহাসে সবচেয়ে কম। অত্যধিক পরিমাণ রুই মাছ তুলে নেওয়ার কারণেই এটা ঘটেছিল। হেক্টর প্রতি লেকের মাছের উৎপাদন বর্তমানে ১০০ কিলোগ্রামের বেশি। রুইমাছের উৎপাদনের অনুপাত ধীরে ধীরে কমে আসায় সামুদ্রিক ক্লুপিডের (Pelagic Clupeids) প্রজনন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে যে দুটি প্রজাতি সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ছে সেগুলি হচ্ছে চাপিলা (Gudnsia chapra) ও কাচকি (Corica soborna)। বর্তমানের মোট ধৃত মাছে এ দুই প্রজাতির অনুপাত ৫০%। প্রাপ্ত মাছের তালিকায় আট প্রজাতির মাছের বাণিজ্যিক গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এগুলি হচ্ছে কাতলা (Catla catla), মৃগেল (Cirrhinus mrigala), রুই (Lebeo rohita), কালিবাউস (L. calbasu), ঘনিয়া (L goinus), চিতল (Notopterus chitala), বোয়াল (Wallago attu) এবং চাপিলা (Gudusia chapra)। কাপ্তাই লেকে রয়েছে মৎস্য চাষের সম্ভাবনা। মৎস্য বিধির বাস্তবায়ন ও উন্নত ব্যবস্থাপনার প্রবর্তন লেকটিকে আরও লাভজনক ও দীর্ঘস্থায়ী করে তুলতে পারে।
সাম্প্রতিক কালে কাপ্তাই লেকের চারপাশে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে পানি দূষিত হওয়ায় জলজপ্রাণীর ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। ১৯৬৬ সালে যেখানে মোট মাছ উৎপাদনের মধ্যে বড় মাছের অংশ ছিল ৭৮%, ১৯৯৩ সালে তা মাত্র ২ শতাংশে নেমে এসেছে। এ ছাড়াও প্রতিদিন লেকটিতে ৫ টনেরও বেশি মনুষ্য বিষ্ঠা ও অন্যান্য বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। লেকের চারপাশের ৮৫ শতাংশ মানুষই পানীয় জল, রান্না, ধোয়া-মোছা, গোসল ইত্যাদির জন্যে এ লেকের পানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ রাঙ্গামাটি শহরে যে পানীয় জল সরবরাহ করছে তাতেও জীবাণুর অনুপাত গ্রহণযোগ্য মাত্রার ১০ গুণেরও বেশি। বদ্ধ ও ধীর গতিসম্পন্ন বিশাল জলাধার মশা ও অন্যান্য পোকামাকড় বংশবিস্তারে খুবই সহায়ক হওয়ায় ম্যালেরিয়া রোগের ঝুঁকিও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। লেকের কারণে আরও কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নৌপরিবহণের কারণে অনেকের পক্ষেই অবৈধভাবে বনজসম্পদ উজাড় করা সম্ভব হচ্ছে বিশেষ করে এমন সব প্রত্যন্ত অগম্য অঞ্চল থেকে, যেখানে লেক সৃষ্টি হওয়ার আগে যোগাযোগ খুবই অসুবিধাজনক ছিল। এর দরুণ ১২৭ বর্গ কিমি ব্যাপী সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং ৬০৬ বর্গ কিমি খাসজমি ও পাহাড়ি বন-জঙ্গল উজাড় হতে চলেছে। [সিফাতুল কাদের চৌধুরী এবং নূরউদ্দিন মাহমুদ]




0 comments:
Post a Comment